ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর অবদান

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর অবদান


1869 খ্রিস্টাব্দে 2 অক্টোবর গান্ধীজীর জন্ম গুজরাটের পোর বন্দরে । 1888 খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং 1891 খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টারি পাস করেন । তিনি রাজকোট ও বোম্বাইয়ে আইন ব্যবসায়ে ব্যর্থ হন । 1893 খ্রিস্টাব্দে দাদা আব্দুল্লাহ এন্ড - কোং এর মামলা লড়তে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান । দক্ষিণ আফ্রিকায় পিটার মারিটসবার্গ  স্টেশনে ট্রেন থেকে গান্ধীকে জোর করে নামিয়ে দেয়া হয় । ডেবিট থোরোর " সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স " লিও টলস্টয় এর " কিংডম অফ গড " এবং জন রাসকিন এর " আন টু দিস লাস্ট "  বইগুলি তার মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে । ডারবানে তিনি ফোনেক্স ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন এবং 1910 খ্রিস্টাব্দে তিনি নাটালে টলস্টয় ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন । 1930 খ্রিস্টাব্দে তিনি  " ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন " নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । 1924 খ্রিস্টাব্দে গান্ধী স্মুট চুক্তি হয় । তুমি নাটালে  " নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস " স্থাপন করেন । লর্ড হার্ডিঞ্জ গান্ধীজীর কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য গোখলেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠান । গোপালের অনুরোধে গান্ধী লন্ডন হয়ে ভারতে ফিরে আসেন 1915 খ্রিস্টাব্দে । গোখলেকে তিনি রাজনৈতিক গুরু এবং টলস্টয়কে তিনি আধ্যাত্মিক গুরু মানতেন । গান্ধীর পিতা ছিলেন কাবা গান্ধী ও মা ছিলেন পুতলিবাঈ । 

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও মহাত্মা গান্ধী :-

 1915 খ্রিস্টাব্দে 46 বছর বয়স্ক গান্ধীজী গুরু গোপালকৃষ্ণ গোখলের পরামর্শে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন । 1916 খ্রিস্টাব্দে তিনি সবরমতী আশ্রম স্থাপন করেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশকে সাহায্যর জন্য কাইজার-ই-হিন্দ স্বর্ণপদক পান । 1917 খ্রিস্টাব্দে তিনি  চম্পারণে ভারতের প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন । নীলকরেরা, স্থানীয় কৃষকদের 3/20 অংশ জমিতে নীল চাষে বাধ্য করতো । একে বলা হতো  " তিন কাঠিয়া " ব্যবস্থা । রাজ কুমার শুক্লা গান্ধীজিকে চম্পারণে যেতে আহ্বান করেন । গান্ধীজীর সঙ্গে এই আন্দোলনে ছিলেন ব্রজকিশোর, রাজেন্দ্র প্রসাদ, গান্ধীজীর ব্যক্তিগত সচিব মহাদেব দেশাই, নরহরি পারেখ, জে . বি কৃপালিনী, এ .এন সিনহা এবং গোরক্ষ প্রসাদ । 1917 খ্রিস্টাব্দে চম্পারন কৃষি বিল পাস হয় । এতে তিন কাঠিয়া ব্যবস্থা বিলোপ করা হয় । 1918 খ্রিস্টাব্দে  গান্ধীজী গুজরাটের খেড়াই আন্দোলন করেন । এই আন্দোলনে গান্ধীজির সঙ্গে ছিলেন বল্লভ ভাই প্যাটেল, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, বি . বি প্যাটেল, এ. সারাভাই সরকার যে তদন্ত কমিশন বসান তাতে ছিলেন বিঠল ভাই প্যাটেল ও জি . কে. পারেখ । 1918 খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী আমেদাবাদে মিল শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন । গান্ধীজীর সঙ্গে ছিলেন অনসূয়া বেন। আন্দোলনের চতুর্থ দিন মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন 35% বাড়িয়ে দেন ।


রাওলাট আইন :-

1917 খ্রিষ্টাব্দে বিচারপতি রাওলাট এর নেতৃত্বে রাওলাট কমিটি গঠিত হয় । এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন স্যার বাশিল স্কট, স্যার ভার্নি লোভেট, সি . ভি . কুমারস্বামী শাস্ত্রী এবং প্রভাস চন্দ্র মিত্র । রাওলাট কমিটি সিডিশন কমিটি নামেও পরিচিত ছিল । 1918 খ্রিস্টাব্দে এই কমিটি রিপোর্ট পেশ করে । 1919 খ্রিস্টাব্দে 6 ফেব্রুয়ারি বিলটি কেন্দ্রীয় আইন সভায় তোলা হয় । 1919 খ্রিস্টাব্দের 18 মার্চ বিলটি  আইনে পরিণত হয় । রাওলাট আইন কে কালা আইন আখ্যা দিয়ে গান্ধীজী 1919 খ্রিস্টাব্দে 6 এপ্রিল সারা ভারতে হরতালের ডাক দেন । এটি ভারতবর্ষের প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট ।  1919 খ্রিস্টাব্দের 4 এপ্রিল গান্ধীজিকে দিল্লি  পালওয়াল স্টেশনের কাছে গ্রেপ্তার করা হয় 


জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড :- 

10 এপ্রিল 1919 খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের দুই নেতা ডঃ সত্যপাল ও সাইফুদ্দিন ইসলামকে গ্রেফতার ও বিনাবিচারে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয় এবং গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হলে জনগণ উন্মত্ত হয়ে ওঠে । 1919 খ্রিস্টাব্দের 13 এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে জনগণ বৈশাখী মেলা উপলক্ষে সমবেত হয় । অমৃতসরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আর. ডায়ার সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে 10 মিনিট ধরে 1600 রাউন্ড গুলি চালান প্রায় 10 হাজার মানুষের ওপর । সরকারি মতে 379 জন মারা যান এবং 1200 জন আহত হন । সামরিক শাসন কর্তা ও ডায়ার অমৃতসরের সান্ধ্য আইন জারি করেন । 1940 খ্রিস্টাব্দে উদম সিং জেনারেল ও ডায়ার কে হত্যা করেন ।জালিয়ানওয়ালাবাগের  ঘটনার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেন । জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য সরকার হান্টার কমিশন বসান । কংগ্রেসের তরফ থেকে অনুসন্ধানের জন্য চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করা হয় । এই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, জয়াকার ও আব্বাস তায়েবজি । 


 গান্ধীজীর খিলাফত আন্দোলন : 

তুরস্কের সুলতান খলিফা ছিলেন মুসলিম জগতের ধর্মগুরু । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যোগ দেয় । যুদ্ধের শেষে তুরস্কের সঙ্গে সেভর এর সন্ধি হয় । তুরস্ক সাম্রাজ্যের কিছু অংশ ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া হয় এবং খলিফার মর্যাদা খর্ব করা হয় । খলিফার সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতীয় মুসলমানরা খেলাফত আন্দোলন শুরু করেন । মোহাম্মদ আলী , সওকত আলী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খাঁ , হজরত মোহানি প্রভৃতি মুসলমান নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন । 1919 খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স প্রতিষ্ঠিত হয় এপ্রিল-মে মাসে । 1919 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে লখনোয় অল ইন্ডিয়া খিলাফত কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয় । সেট চট্টানি ছিলেন সভাপতি ও শওকত আলী ছিলেন সেক্রেটারি । 1920 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা অধিবেশনে খিলাফত কনফারেন্স এর সভাপতি হন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ । গান্ধীজী খেলাফত আন্দোলন কে সমর্থন করেন এবং কাইজার-ই-হিন্দ স্বর্ণপদক ফেরত দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন । 1921 খ্রিস্টাব্দের 4 জুলাই অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স করাচি অধিবেশনে ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে মুসলমানদের পদত্যাগ করার দাবি করা হয় । 1924 খ্রিস্টাব্দে মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের খলিফা পদের অবসান ঘটলে ভারতে খিলাফত আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয় । 


অসহযোগ আন্দোলন (1920 - 1922) : 

1920 খ্রিস্টাব্দে  লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে । গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বরাজ অর্জনের জন্য একটি পরিকল্পনা পেশ করেন । চিত্তরঞ্জন দাশ ,  মদনমোহন মালব্য , বিপিনচন্দ্র পাল ,  অ্যানি বেসান্ত , জিন্না গান্ধীজীর এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন , কিন্তু মতিলাল নেহেরুর সহযোগিতায় গান্ধীজীর প্রস্তাব পাস হয় । 1920 খ্রিস্টাব্দে নাগপুর অধিবেশন অহিংস অসহযোগে এর প্রস্তাব পুনরায় গৃহীত হয় । কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসাবে কিস্তির হয়  "স্বরাজ পন্থা" হিসেবে স্থির হয় "অহিংস অসহযোগ"  ও নেতা অন গান্ধীজি । অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে সরকারি চাকরি , অনুষ্ঠান , খেতাব , আইনসভা ইত্যাদি বর্জন ,  অন্যদিকে গঠনমূলক কর্মসূচির মধ্যে ছিল দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন , সালিশ বোর্ড গঠন , মাদক বর্জন , চরকা ও খদ্দরের প্রচলন ইত্যাদি । 

জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া , কাশি বিদ্যাপীঠ, বিহার বিদ্যাপীঠ , গুজরাট বিদ্যাপীঠ , বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন , মতিলাল নেহেরু , বিঠলভাই প্যাটেল, বল্লভ ভাই প্যাটেল , চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী প্রমুখ আইন ছেড়ে এই আন্দোলনে যোগ দেন । সুভাষচন্দ্র বসু আই .সি . এস এর চাকরি ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন । " তিলক স্বরাজ তহবিল " গঠিত হয়, এই তহবিলে এক কোটি টাকা জমা পড়ে । 1921 খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স অব ওয়েল ভারতে এলে বোম্বাই ও কলকাতায় ধর্মঘট হয় । 

বাসন্তী দেবী , সরোজিনী নাইডু , জ্যোতির্ময় গঙ্গোপাধ্যায় , উর্মিলা দেবী ,  হেমাপ্রভা মজুমদার প্রমুখ নারী এই আন্দোলনে যোগ দেন । 1922 খ্রিস্টাব্দে 5 ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা নামে দুটি গ্রামের উত্তেজিত জনতা 22 জন পুলিশ কে পুড়িয়ে মারে । অহিংস আন্দোলন সহিংস পথে গেলে 1922 খ্রিস্টাব্দে এর 11 ই ফেব্রুয়ারি আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয় । 10 শে মার্চ গান্ধীজিকে গ্রেফতার করে ছয় বছর কারাদণ্ড ও জহরলাল নেহেরু কে 18 মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয় । 


স্বরাজ্য দল : 

1922 খ্রিস্টাব্দে গয়া কংগ্রেস অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন দাশ ,  মতিলাল নেহেরু , হাকিম আজমল খাঁ ,বিঠলভাই প্যাটেল , মালব্য , শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার,  কেলকার , জয়াকার , সত্যমূর্তি প্রমুখ পরিবর্তনের সমর্থক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ও আইন সভায় প্রবেশ এর পক্ষে মত দেন । অন্যদিকে বল ভাই প্যাটেল , রাজেন্দ্রপ্রসাদ , ডাক্তার আনসারী , চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী প্রমুখ ছিলেন পরিবর্তনের বিরোধী । তারা সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন । পরিবর্তনের সমর্থকরা ভোট পায় 890 টি ও বিরোধীরা পায় 1740 টি । মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন দাস 1923 খ্রিস্টাব্দের 1 জানুয়ারি " স্বরাজ " দল গঠন করেন । চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন সভাপতি ও মতিলাল নেহেরু ছিলেন সাধারণ সম্পাদক । 

1923 খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে 62 লক্ষ লোক অংশ নেয় । কেন্দ্রীয় আইন সভায় 101 টি আসনের মধ্যে স্বরাজ দল প্রায় 42 টি আসন । বোম্বাই যুক্তপ্রদেশ ও আসামে এই দল সাফল্য পায় । বাংলা এবং মধ্যপ্রদেশে এই দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় । 1925 খ্রিস্টাব্দে বিঠলভাই প্যাটেল কেন্দ্রীয় আইন সভায় সভাপতিত্ব বা স্পিকার নির্বাচিত হন ।     স্বরাজ দল মুসলমান সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জাতীয়তাবাদী দল বা ন্যাশনালিস্ট পার্টি গঠন করেন । 

1923 খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে বাংলার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি , মাদ্রাজে  শেষাগ্রী আইয়ার , বোম্বের পরাঙ্জপে ,  উত্তরপ্রদেশের চিন্তামণি , এইচ. কুঞ্জরু , প্রমুখ নেতা পরাস্ত হন । চিত্তরঞ্জন দাশ  কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন ও সুভাষচন্দ্র বসু মুখ্য কার্যনির্বাহী অফিসার নির্বাচিত হন । বল্লভ ভাই প্যাটেল আমেদাবাদ কর্পোরেশনের , জহরলাল নেহেরু এলাবাদ কর্পোরেশনের , রাজেন্দ্র প্রসাদ পাটনা কর্পোরেশনের , মেয়র নির্বাচিত হন । স্বরাজ্য দল 1924 খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার মুদিম্যান  কমিটি ও লি কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদ করে। 

1925 খ্রিস্টাব্দের চিত্তরঞ্জন এর মৃত্যু হয় । 1926 খ্রিস্টাব্দে স্বরাজ্য দল তিনভাগে ভাগ হয়  যথা ,  স্বরাজ্য দল , রেসপনসিভিস্টরা  ইন্ডিপেন্ডেন্ট কংগ্রেস পার্টি । 1926 খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে 104 আসনের মধ্যে স্বরাজ দল প্রায় 40 টি আসন । বাংলায় তারা অধিকাংশ আসন পায় । বিহার ও উড়িষ্যাতে রেসপনসিভিস্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল । মধ্য প্রদেশ ,পাঞ্জাব , উত্তর প্রদেশে স্বরাজ্য দল হেরে যায় । 


সাইমন কমিশন : 

1919  খ্রিস্টাব্দে শাসন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে সাইমন কমিশন নিযুক্ত হয় 1927 খ্রিস্টাব্দে । স্যার জন  সাইমনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিশনে কোন ভারতীয় সদস্য ছিল না । এজন্য একে অল হোয়াইট কমিশন বলা হয় । 1928 খ্রিস্টাব্দের 3 ফেব্রুয়ারি সাইমন কমিশন বোম্বাইতে আসে । মুসলিম লীগের সভাপতি মোঃ ইয়াকুব সাইমন কমিশন বয়কট করেন । মুসলিম লীগ , হিন্দু মহাসভা এবং লিবারেল ফেডারেশন সাইমন কমিশন বয়কটের এর সিদ্ধান্ত নেয় । 1928 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ের "সাইমন ফিরে যাও" ধ্বনি ওঠে । লালা লাজপত রায় কমিশন বিরোধী মিছিল পরিচালনা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে প্রহুত হন । 1930 খ্রিস্টাব্দের 13 ই জানুয়ারি কমিশন তাজা রিপোর্ট পেশ করে । এই রিপোর্টের ভিত্তিতে 1935 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন রচিত হয় । 


কংগ্রেসের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি : 

1927 খ্রিস্টাব্দে ভারত সচিব বার্কেনহেড সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন । এর জবাবে 1927 খ্রিস্টাব্দে এর 27 শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু ও জহরলাল নেহেরু পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে । 1928 খ্রিস্টাব্দের 12 ই ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে এম.এ. আনসারীর নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় । এই সভায় সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করা হয় । 1928 খ্রিস্টাব্দে 19 মে বোম্বাই মিটিংয়ে মতিলাল নেহেরুকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে একটি কমিটি গঠিত হয় ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা করতে । 1928 খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে সর্বদলীয় লখনও সম্মেলনের অধিবেশনে মতিলাল নেহেরু সংবিধানের খসড়া টি পেশ করেন । এটি নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত । মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং হিন্দু মহাসভার নেতা এম. আর জয়াকার এই রিপোর্টের বিরোধিতা করেন । 1929 খ্রিস্টাব্দে 28 মার্চ মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে 14 দফা দাবি পেশ করেন । নেহেরু রিপোর্টের ভারতের জন্য ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দাবি করা হয় । 

1929 খ্রিস্টাব্দে 31 অক্টোবর লর্ড আরউইন বলেন ভারতকে উপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য । কিন্তু উইনস্টন চার্চিল ভারতকে ডোমিনিয়ন এর মর্যাদা দান কে এক গুরুতর অপরাধ বলে মনে করেন । 1929 খ্রিস্টাব্দে 31 ডিসেম্বর লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে রাভি নদীর তীরে জহরলাল নেহেরুর কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করেন । গান্ধীজী 6 বছর কারাবাসের পরে আবার লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান । কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সমিতি থেকে বামপন্থী সুভাষচন্দ্র বসু ও শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার কে বাদ দেয়া হয় । 1930 খ্রিস্টাব্দে 2 জানুয়ারি কংগ্রেসের নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকের স্থির হয় 26 শে জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হবে । 


আইন অমান্য আন্দোলন (1930 - 1934) : 

আন্দোলন শুরুর পূর্বে 1930 খ্রিস্টাব্দে 30 শে জানুয়ারি গান্ধীজী সরকারের কাছে 30 দফা দাবি পেশ করেন তার " ইয়ং ইন্ডিয়া " পত্রিকার মাধ্যমে গান্ধীজী লবন আইন ভঙ্গের জন্য 1930 খ্রিস্টাব্দে 12 ই মার্চ ডান্ডি অভিযান করেন । গান্ধীজির সঙ্গে 78 জন ( মতান্তরে 79 জন ) স্বেচ্ছাসেবী 24 দিনে 241 মাইল পথ অতিক্রম করে ডান্ডি পৌঁছান । 6 গান্ধীজী স্বহস্তে লবণ তৈরি করে লবণ আইন ভঙ্গ করে আইন অমান্য আন্দোলন সূচনা করেন । 

আইন অমান্য আন্দোলন তামিলনাড়ুতে নেতৃত্ব দেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী ,  অন্ধ ও উড়িষ্যার গোপবন্ধু চৌধুরী  (উৎকালমনি), বোম্বাই যমুনালাল বাজাজ, পাঞ্জাবে তারা সিং , উত্তরপ্রদেশে কালকা প্রসাদ ,  বিহার রাজেন্দ্র প্রসাদ ,  মনিপুরের রাণী গুইডিলু , আসামে তরুণ রাম ফুকোন , এলাহাবাদে এম . এন রায় , বাংলা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত প্রমুখ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ।  মহিলাদের মধ্যে কমলা নেহেরু , স্বরূপ রানী নেহরু , সরোজিনী নাইডু , বাসন্তী দেবী , উর্মিলা দেবী , সরলাবালা দেবী , লীনা নাগ প্রমুখ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন । 

1930 খ্রিস্টাব্দে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশের চৌকিদারি কর , লবণ কর ,  মাদকদ্রব্য ও ভূমি কর না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয় । উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গান্ধীবাদী নেতা সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফর খান । তিনি খুদাই-খিদমতগার বা ঈশ্বরের সেবক দলের প্রতিষ্ঠা করেন । এই দলের সদস্যরা লাল পোশাক পরত বলে এদের লাল কুর্তা বলা হত । গান্ধীজীর সুরাট জেলার সরকারি লবনগোলা দখলের সিদ্ধান্ত নিলে প্রথমে গান্ধীজিকে এবং তারপর আব্বাস তায়েবজিকে সরকার গ্রেপ্তার করলে সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয় । 1930 খ্রিস্টাব্দে 1 এপ্রিল বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল এবং 27 এপ্রিল 1910 খ্রিস্টাব্দে প্রেস অর্ডিন্যান্স পুনঃ: প্রবর্তিত হয় । 


গান্ধী আরউইন চুক্তি (1931) : 

তেজ বাহাদুর সপ্রু , ডক্টর জয়াকার এবং অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় 1931 খ্রিস্টাব্দের 5 মার্চ gandhi-irwin চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে গান্ধীজী ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যেতে রাজি হন । 


প্রথম গোল টেবিল বৈঠক :

ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় 12 ই নভেম্বর 1931 খ্রিস্টাব্দে । 1929 খ্রিস্টাব্দে 31 শে অক্টোবর লর্ড আরউইন তার ঘোষণাপত্র জারি করেন । প্রথম গোল টেবিল বৈঠক এর সভাপতি ছিলেন রামসে ম্যাকডোনাল্ড । 16 জন সদস্য ব্রিটিশ রাজনৈতিক পার্টি থেকে 16 জন সদস্য ভারতীয় রাজা থেকে এবং 57 জন সদস্য ব্রিটিশ ভারত থেকে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান । মুসলিম লীগের হয়ে যোগদান মোহাম্মদ আলী , মোহাম্মদ সফি, জিন্না , আগা খান এবং ফজলুল হক । হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে মুঞ্জে ও জয়কার যোগদান । ইন্ডিয়ান লিবারাল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে যোগ দেন  তেজ বাহাদুর সপ্রু , চিন্তামণি , শ্রীনিবাস শাস্ত্রী । শিখ সম্প্রদায়ের পক্ষে যোগ দেন সর্দার উজ্জ্বল সিং । ডিপ্রেসড ক্লাসের পক্ষে যোগ দেন ডঃ বি আর আম্বেদকর । 

প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আইসিএস ও আইপিএস পরীক্ষা ভারতবর্ষে নেয়া হবে । সেনাবাহিনীকে ভারতীয়করণ করা হবে । উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জন্য একজন মন্ত্রী নিয়োগ করা হবে । ভারত থেকে ব্রহ্মদেশ আলাদা করা হবে । বোম্বাই থেকে সিন্ধু প্রদেশ আলাদা করা হবে । প্রদেশ গুলোকে স্বশাসন দান করা হবে । 


দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক : 

দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক 7 সেপ্টেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে । এই বৈঠকে আরো 30 জন নতুন প্রতিনিধি যোগদান করেন । গান্ধীজী 6 ডিসেম্বর লন্ডন ত্যাগ করেন 28 ডিসেম্বর শূন্যহাতে মুম্বাই ফিরে আসেন । এই বৈঠকে যোগদান কারী দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেতারা ছিলেন আম্বেদকর , সপ্রু , জয়কার , সরোজিনী নাইডু মালব্য প্রমুখ ।


তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক :   

1932 খ্রিস্টাব্দের 17 নভেম্বর থেকে 24 ডিসেম্বর পর্যন্ত লন্ডনে তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । কংগ্রেস তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক বয়কট করে । শুধু মাত্র 46 জন প্রতিনিধি এই অধিবেশনে যোগ দেন । সেক্রেটারি অফ স্টেটস ছিলেন স্যামুয়েল হোড় । 1933 খ্রিস্টাব্দে হোয়াইট পেপার প্রকাশ করা হয় এবং হাউস অব কমন্সের উত্থাপন করা হয় । শেষ পর্যন্ত 1935 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে এটি প্রকাশিত হয় । 


আইন অমান্য আন্দোলন দ্বিতীয় পর্যায় : 

দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে gandhi-irwin চুক্তির শর্তাদি কার্যকরী   না হওয়ায়,  উত্তরপ্রদেশে খাজনা বন্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জহরলাল নেহেরু ও পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডনকে কারারুদ্ধ করা হয় । উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আবদুল গফফর খান এর লাল কুর্তা বাহিনী কে বেআইনি ঘোষণা করা হয় । 1932 খ্রিস্টাব্দের 4 জানুয়ারি মাসে সরকার চারটি নতুন দমনমূলক অর্ডিন্যান্স জারি করেন । 1932 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গান্ধীজিকে বন্দি করা হয় । সরকারের দমননীতি বৃদ্ধি পায় । বিলেতের ইন্ডিয়া লীগ পরিচালিত ডেলিগেশন রিপোর্টে দমন নীতির একটি প্রকট হয়ে ওঠে । 1933 খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজীর কারামুক্তির পর তিনি হরিজন আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন । 1934 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বিহারে ভূমিকম্পের পর এই আন্দোলন চাপা পড়ে যায় । 4 মে পাটনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে অনুষ্ঠানিকভাবে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয় । 


কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব :  

1938 সালে হরিপুরা কংগ্রেসের সুভাষ চন্দ্র বসু সভাপতি পদে নির্বাচিত হন । তার ভাবনা চিন্তা ও পরিকল্পনায় দক্ষিণপন্থীদের খুশি করতে পারেননি । তাই 1939 সালে সুভাষচন্দ্র যখন দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন কংগ্রেসে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় । ফলে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন নিয়ে সংকট দেখা দিল । গান্ধীজী সুভাষচন্দ্র কে সমর্থন করলেন না । তার মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতা রামাইয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো সুভাষচন্দ্রের । সুভাষচন্দ্র জয় লাভ করলেন 1580 এবং 1377 ভোটে । নিজের মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়ের গান্ধীজী ক্ষোবভ ও বিষন্ন মনে বলেন , "আমার চেষ্টাতেই ডক্টর পট্টভি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি । অতএব এই পরাজয় তার অপেক্ষা আমারই অধিক । " নির্বাচনের পর সমস্যা এমন জটিল হয়ে উঠল যে সুভাষচন্দ্র পদত্যাগ করলেন । এরপর তিনি " ফরওয়ার্ড ব্লক " নামে একটা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন । 


স্টেটস পিউপিল স্ট্রাগল বা দেশীয় রাজ্যগুলির জনগণের আন্দোলন :  

1930 এর দশকে দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে জাতীয় আন্দোলন প্রসার লাভ করে এবং রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে । বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করার লক্ষ্যে এবং জনপ্রিয় সরকার গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আন্দোলন শুরু করে । " অল ইন্ডিয়া স্টেট পিপলস কনফারেন্স " গড়ে ওঠে 1927 সালের ডিসেম্বর মাসে বিভিন্ন রাজ্যগুলির মধ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ এর সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্য । এইসব রাজ্যর জনগণের মধ্যে দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলন গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক উন্মাদনা সৃষ্টি করে । ভারতের জাতীয় কংগ্রেস স্টেটস পিপলস স্ট্রাগেল সমর্থন করে এবং দেশীয় রাজাদের কাছে আবেদন জানায় যাতে তারা গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এর সূচনা করেন এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন । 1939 সালে অল ইন্ডিয়া স্টেট পিপলস কনফারেন্স এর সভাপতি হন জহরলাল নেহেরু । এই আন্দোলনের বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য জনগণের মধ্যে জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধি করেছিল । 


ক্রিপস প্রস্তাব : 

1941 খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি পাল হারবার আক্রমণ করে । মিত্র পক্ষের বিরুদ্ধে জাপানের যুদ্ধ প্রয়াস পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে জাপান ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ , ইন্দোনেশিয়া , ইন্দোচীন , মালয় , সিঙ্গাপুর , ব্রহ্মদেশ অধিকার করে নেয় । ভারতের উপর জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয় । এই সময় ভারতে ব্রিটিশদের অবস্থা ছিল শোচনীয় । প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল শোচনীয় । ভারতবাসীর সহযোগিতা ভিন্ন জাপানের আক্রমণ প্রতিহত করা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না । মিত্রপক্ষের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে যে , ব্রিটেনের রাজ্য বাদী স্বার্থই ভারতের সমস্যা সমাধানের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ভারতকে অবিলম্বে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এবং ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন । এরূপ পরিস্থিতিতে ভারতের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য এবং জাপানি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায় ভারতবাসী সহযোগিতা লাভ করার উদ্দেশ্যে স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস কে একটি খসড়া প্রস্তাবসহ ভারতে পাঠান । ক্রিপস ছিলেন একজন খ্যাতনামা আইনজীবী এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী । তিনি ব্যক্তিগতভাবে জহরলাল নেহেরুর ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন । 

স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসে ভাইসরয়ের কার্য নির্বাহক কমিটির কাছে 23 শে মার্চ 1942 খ্রিস্টাব্দে তার প্রস্তাব আলোচনা করেন এবং দুদিন ধরে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রস্তাবটি সর্বসাধারণের অবগতির জন্য পত্র পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেন । 

এই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয় যে  -  

1)   আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের জন্য শীঘ্রই ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করা হবে এবং সেটিকে ডোমিনিয়ন এর মর্যাদা দেয়া হবে । এই ডোমিনিয়ন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অপরাপর ডোমিনিয়ন এর সম মর্যাদা লাভ করবে । 

2)  যুদ্ধা বসানে নিয়ে ভারতীয় প্রতিনিধিগণ কে নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে । ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এই সংবিধান সভার চুক্তিবদ্ধ হবে এবং সেই চুক্তি অনুসারে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে । তা ভিন্ন এ চুক্তিতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ও অন্যান্য বিষয়ে সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি থাকবে । 

3)  ভারতের কোন প্রদেশে বা দেশীয় রাজ্য নতুন শাসনতন্ত্র গ্রহণে অস্বীকৃত হলে সে প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজস্ব শাসনতন্ত্র রচনার করবে । 

4)  সংবিধান সভার সদস্য গণ প্রাদেশিক আইন সভা , কর্তৃক নির্বাচিত হবেন । 

5)  ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভাইসরয়ের ভিডিও ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার থাকবে । 

ক্রীপস প্রস্তাবের ব্যর্থতার কারণগুলি হল : 

1)  প্রস্তাবে ভারতকে স্বাধীনতা দানের কোনো উল্লেখ ছিল না । 

2)  ভারতের প্রতিরক্ষা পূর্ণ দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ করেননি । 

3)  প্রস্তাবিত জাতীয় সরকার কে ক্যাবিনেটের সম মর্যাদা দান ও ক্ষমতা দান এর কোন প্রতিশ্রুতি ছিল না । 

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস উপরিক্ত কারণে ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জাতীয় কংগ্রেস দৃঢ়তার সঙ্গে জানায় যে কেবলমাত্রর মৌখিকভাবে প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে পূর্ণণ সহযোগিতা করা সম্ভবপর নয় । মুসলিম লীগ পৃথক রাষ্ট্রর গঠনের দাবিকে অধিকতর গুরুত্ব জ্ঞাপন করেে । এবং প্রস্তাবকে অবাঞ্চিত বলে ঘোষণা করে । হিন্দু মহাসভা এই প্রস্তাবে দেশবিভাগের সম্ভাবনাা দেখতে পায় এবং সেই কারণে প্রত্যাখ্যান করে। শিখ সম্প্রদায়় এবং আম্বেদকর এর পরিচালনাধীন হরিজন সম্প্রদায় ক্রিপস প্রস্তাব কে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে । মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে ব্যর্থ হন । ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এর নির্দেশে আলাপ আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে মি. ক্রীপস প্রস্তাব সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন যে এটি একটি পতনশীল ব্যাংকের ওপর ভবিষ্যৎ তারিখে একটি চেকের সামিল । ( " a post-dated cheque on a crashing bank " ) । 


মহাত্মা গান্ধীর ভারতছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন : 

1939 খ্রিস্টাব্দে 3 সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ আরম্ভ হলে ভারত সরকার ভারতকে যুদ্ধরত দেশ ঘোষণা করে । 1940 খ্রিস্টাব্দে রামগড় অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করে । 1940 খ্রিস্টাব্দের 8  আগস্ট বড়লাট লিনলিথগো ঘোষণা করেন যে — 

1) যুদ্ধান্তে ভারতকে ডোমিনিয়ন এর মর্যাদা দেয়া হবে ।

2) বড়লাটের কার্যনির্বাহী সমিতিতে ভারতীয় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে ।

3) ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা পর্ষদ গঠন করা হবে ।

4) যুদ্ধান্তে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে । এটি আগস্ট ঘোষণা নামে পরিচিত 1941 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বড়লাটের কার্যনির্বাহী কমিটিতে সদস্য সংখ্যা 7 থেকে হারিয়ে 12 করা হয় । কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে যোগ দেয়নি

        1940 খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক দল আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন । 1940 খ্রিস্টাব্দে 17 ই অক্টোবর গান্ধীজীর নির্দেশে বিনোবা ভাবে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু করেন । মলানা আবুল কলাম আজাদ , রাজাগোপালাচারী সহ প্রায় আড়াই হাজার সত্যগ্রহি কারাবরণ করেন । 1941 খ্রিস্টাব্দে সত্যাগ্রহ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় । 1941 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি কর্তৃক রাশিয়া আক্রান্ত হলে কম্যুনিস্ট পার্টির যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সামিল হয় । 

        1942 খ্রিস্টাব্দের 4 এ মার্চ জাপানের হাতে রেঙ্গুনের পতন হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে । ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মন্ত্রিসভার সদস্য আইনজ্ঞ স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস কে ভারতে পাঠান । 23 মার্চ তিনি দিল্লি পৌঁছান । 29 শে মার্চ ভারতের নেতৃত্ব বৃন্দ দের সামনে তিনি একটি প্রস্তাব রাখেন । এই প্রস্তাব ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত । কংগ্রেস, শিখ,  হিন্দু মহাসভা , ন্যাশনাল লিবারেল ফেডারেশন , ভারতীয় খ্রিস্টান ক্রিপস মিশন এর বিরোধিতা করেন । মুসলিম লীগ ও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্রিপস মিশন কে স্বাগত জানাই । 


           1942 খ্রিস্টাব্দে 8 আগস্ট বোম্বাইয়ের নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয় । গান্ধীজী 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে'  বা " Do or Die " এর ডাক দেন । 

9 আগস্ট গান্ধীজি ও সরোজিনী নাইডু কে বন্দি করে আগাখান প্যালেসে রাখা হয় । কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করে কংগ্রেসের অপর নেতাদের বন্দি করা হয় । গান্ধীজীর উপর আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ সৃষ্টি হয় । গান্ধীজী অনশন আন্দোলন করেন ।ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রতি সরকার ও সমন্তরাল সরকার গড়ে ওঠে । 

         বোম্বাইয়ের অরুনা আসফ আলী ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মিছিলে 4 জন মারা যান ও 169 জন আহত হন । সাতারাতে প্রতি-সরকার গড়ে ওঠে Y.B. চৌহান ও নানা পাতিল এর নেতৃত্বে । মদন ঝাঁ বিহারের সমন্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেন ।উত্তরপ্রদেশের বলিয়া তে চিতু পান্ডে একটি সমন্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে বলেন স্বরাজ তফশিলদার । উড়িষ্যার বালাসরে স্বরাজ পঞ্চায়েত গঠিত হয় এবং উড়িষ্যাতে রক্ষা বাহিনী গঠিত হয় । উড়িষ্যার লক্ষণ নায়ক নামে কংগ্রেস নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয় । আসামে শান্তি সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয় । 

         মেদনীপুরের তমলুক তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় । তার সর্বাধুনিক ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত ও তার দুই বিশিষ্ট অনুগামী অজয় মুখার্জি ও সুশীল ধাড়া সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম , মহিষাদল ও তমলুক এই চারটি থানা ছিল জাতীয় সরকারের অধীন । তমলুক , নন্দীগ্রাম ও মহিষাদলে এ বিদ্যুত বাহিনী বা জাতীয় বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হয় । 73 বছরের তমলুকের হোগলা গ্রামের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা মিছিল পরিচালনা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন । তিনি পরিচিত "গান্ধী বুড়ি " নামে । তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার 17 ডিসেম্বর  1942 থেকে 1 সেপ্টেম্বর 1944 পর্যন্ত স্বাধীনভাবে শাসন করে ।

        ভারতের অন্যান্য বিখ্যাত নেতাদের মধ্যে ছিলেন অচু্্যত পট্টবর্ধন ,  অরুনা আসফ আলী , রামমমোহর লোহিয়া ,  বিজু পট্টনায়ক , সুচেতা কৃপালিনী , গোপিনাথ বরদলি , শাদিক আলি , জয়প্রকাশ নারায়ণ , ছোটুভাই , আর. পি  গোয়েঙ্কা,  নরেন্দ্র দেব , যোগেশ চ্যাটার্জী , ঊষা মেটা , চন্দ্রকান্ত জাবেরি , বিটলধর বাবু ভাই , দয়া ভাই প্যাটেল , বিটল দাস প্রমূখ । নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আসামের 13 বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া , পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভোগেশ্বরী ফুকননী প্রমুখ ।