সিপাহি বিদ্রোহ ১৮৫৭ (মহাবিদ্রোহ)

সিপাহি বিদ্রোহ 1857

1857 খ্রিস্টাব্দে বড়লাট ক্যানিং - এর শাসনকালে (1856 -  1862) খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে । এই বিদ্রোহ ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয় । এই বিদ্রোহ প্রথম শুরু করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সৈনিক বা  সিপাহিরা । এই কারণে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকেরা এই বিদ্রোহকে 'সিপাহী বিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন । বলাবাহুল্য এই মত যুক্তি সম্মত নয় । এই বিদ্রোহ পূর্ববর্তী বিদ্রোহ গুলির মত কোন স্থানীয় বা বিশেষ কোন গোষ্ঠীর বিদ্রোহ ছিল না । ভারতের যেমন এক বিস্তীর্ণণ স্থানে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল । তেমনি বিদ্রোহের সূচনায় অল্পদিনের মধ্যেই দেশের রাজা প্রজা সৈনিক সাধারণ মানুষ সর্বশ্রেণী ও সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেছিল। কোন কোন অঞ্চলে সিপাহিদের না থেকে জনসাধারণ নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে  বিদ্রোহে অংশ নেয়, আবার কোথাও বা জনতায় সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহে প্রণোদিত করে , তাই এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ না বলে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ বলা যুক্তিসংগত । এই বিদ্রোহ ছিল সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের পুঞ্জী্জিভূত বিক্ষভের ফল । 


1857 খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের কারণ 


● রাজনৈতিক কারণ : - 1757 খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে 100 বছরের মধ্যে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অংশে ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় । ইংরেজ সামরিক শক্তির কাছে প্রধানত হলেও ভারতীয় রাজন্যবর্গ কোনদিনই ইংরেজ শাসন কে মেনে নিতে পারেননি । লর্ড ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতি রাজন্যবর্গ প্রজাবর্গের মধ্যে এক তীব্র ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে । স্বত্ববিলোপ নীতি কুশাসনের অজুহাতে তিনি সাতারা, সম্বলপুর, নাগপুর, ঝাসি, তাঞ্জোর, কর্ণাটক, অযোধ্যা প্রভৃতি রাজ্যগুলি গ্রাস করেন । পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এর দত্তক পুত্র নানা সাহেবের বাৎসরিক ভাতা ও পেশোয়া পদ তিনি লুপ্ত করেন । তিনি দিল্লির বাদশা কে তার প্রাসাদ থেকে বহিস্কৃত  করেন এবং তার উপাধি বিলুপ্ত করা হয় । বলাবাহুল্য রাজন্যবর্গের প্রতি এই হীন আচরণ হিন্দু-মুসলিম সাধারণ ভারতবাসী ভালো চোখে দেখেনি । ডালহৌসি নির্লজ্জভাবে অযোধ্যা ও নাগপুর এর রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করেন । ঐতিহাসিক জন কে লিখেছেন যে রাজপরিবারের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠিত হয় । আসবাবপত্রাদি , মণিমুক্তা , অলংকার এমনকি হাতি ঘোড়া পর্যন্ত লুণ্ঠিত হয় হয় এবং এর কিছু কলকাতায় প্রকাশ্যভাবে বিক্রি করা হয় । বলাবাহুল্য এই সব কার্যকলাপ সাধারণ প্রজাবর্গের মনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ভারতীয় রাজন্যবর্গের মনে তীব্র আতঙ্ক ও অসন্তোষের সৃষ্টি করে । জন কে লিখেছেন যে নাগপুর রাজ্য দখল অপেক্ষাও এই ধরনের নির্লজ্জ লুণ্ঠন ও মালপত্র বিক্রির ঘটনা সন্নিহিত প্রদেশগুলোতে অধিকতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । ইংরেজ কর্তিক অধিকৃত বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যোর রাজপরিবারের আশ্রিত ব্যাক্তিগন, জমিদার, তালুকদার ও সেনাদল কর্মচ্যুত ও জীবিকা হীন হয়ে পড়ে । এর ফলে তাদের মধ্যে তীব্র নৈরাশ্য ও প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয় । 

● অর্থনৈতিক কারণ :-   ইংরেজদের স্বৈরাচারী ও সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক শোষণ এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয়দের মনে তীব্র অসন্তোষ পুঞ্জিভূত হয় । 1757 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1857 খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত এই 100 বছরের মধ্যে কোম্পানি এদেশ থেকে প্রচুর সোনা - রুপা ইংল্যান্ড এ নিয়ে যায় । তাদের একচেটিয়া বাণিজ্যেক অধিকার যেমন এদেশীয় বণিকদের দুর্দশার কারণ হয়, তেমনি শুল্ক-রহিত ইংল্যান্ডজাত পর্নো সামগ্রী সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় দেশীয় কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর টিকতে পারেনি । এর ফলে ভারতীয় কুটির শিল্প বিশেষত তাঁত শিল্প ধ্বংস হয় এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় । ভারত পরিণত হয় ম্যানচেস্টার ও ল্যাঙ্কাসায়ের কাঁচামাল সরবরাহের উৎস ও উৎপন্ন পণ্যের বাজারে । ইংরেজদের ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব নীতি দেশবাসীকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয় । বেন্টিং এর ভূমি সংস্কার নীতির ফলে বহু প্রাচীন জমিদার বংশ অবলুপ্ত হয় এবং ডালহৌসি নিযুক্ত "ইনাম কমিশন" বোম্বাই প্রেসিডেন্সি প্রায় 200000 জমিদারি বাজেয়াপ্ত করায় দেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়ে ওঠে । দরিদ্র কৃষকদের উপর অসহনীয় করভার চাপানো হয় । গদিচ্যুত শাসকদের আশ্রিত ব্যাক্তি, কর্মচ্যুত সেনাদল রাজকর্মচারী ও অভিজাত পরিবার বর্গের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায় । লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কৃষক , প্রাচীন জমিদার সম্প্রদায় ও সাধারণ গ্রামবাসীর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে । মাদ্রাজের " উত্তর সরকার " অঞ্চলের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার ফলে জমিদার শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয় । মাদ্রাজে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার ফলে ভূমি রাজস্ব এর পরিমাণ প্রায় 30 40 গুণ বৃদ্ধি পায় । অযোধ্যায় প্রবর্তিত ব্রিটিশ রাজস্ব নীতি এবং এই অঞ্চলের মুখ্য কমিশনার জ্যাকসন সাহেবের অসহায় অনুভূতি পূর্ণ মনোভাবের ফলে তালুকদার ও কৃষকদের দুর্দশার অন্ত ছিল না । চৌকিদার কর, পথকর, যানবাহন ও অন্যান্য নানা করভার প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে । দেশীয় রাজন্যবর্গ শিল্পী-সাহিত্যিক সঙ্গীতজ্ঞ প্রভৃতি নানা গুনীজনদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন । মন্দির, মসজিদ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁরা নিষ্কর ভূমি ও অন্যান্য সাহায্য দান করতেন । দেশীয় রাজ্যগুলি ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে এই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলি ও ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় ।জনকে লিখেছেন যে কর্মচ্যুত হওয়ার পর অবস্থা এমনই দাঁড়িয়ে ছিল যে মূল্যবান আসবাবপত্র ও অলংকার সামগ্রী বিক্রির পর এইসব অভিজাত পরিবারের মহিলারা রাত্রির অন্ধকারে অন্যের গৃহে গিয়ে ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করতেন সুতরাং এই অবস্থার বিরুদ্ধে জনগণ যে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই । 


● সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ : -   ভারতে কোম্পানির শাসন প্রবর্তিত হওয়ার সময় থেকেই ইংরেজরা ভারত বাসি তাদের আচার-আচরণ ও সামাজিক রীতিনীতি কে তীব্রভাবে ঘৃণা করতো । ইংরেজদের চোখে ভারতীয়রা বর্বর ছাড়া অন্য কিছু ছিল না । 1780 খ্রিস্টাব্দে রচিত " সিয়ার-উল-মুতাখরিন " গ্রন্থে বলা হয়েছে যে ইংরেজরা ইচ্ছে করেই ভারতীয়দের সংস্পর্শ বর্জন করে চলত । স্যার সৈয়দ আহমেদ খান লিখেছেন যে ইংরেজ রাজকর্মচারীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে সম্ভ্রান্ত ভারতীয়রাও ভীত হয়ে উঠতেন । 1778 খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস লিখেছেন যে কয়েক বছর পূর্বেও অধিকাংশ ইংরেজ ভারতীয়দের বর্বর বলেই মনে করত । ভারতীয়দের প্রতি তাদের বিজেতা সুলভ উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শাসক ও শোষিতের মধ্যে বিরাট ব্যবধানের সৃষ্টি করে । এর ফলে ইংরেজদের সম্পর্কে ভারতীয় মনে স্থায়ী সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয় । এমনকি তাদের জনহিতকর কার্যবলি কেউ ভারতবাসী সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে । খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের ধর্ম প্রচারের চেষ্টা ও হিন্দু মুসলিম ধর্ম সম্পর্কে তাদের বিষোদগার ভারতীয় মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । ইংরেজি শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন এবং সতীদাহ ও শিশুহত্যা নিবারণ প্রভৃতি আইন - এমনকি রেলওয়ে, টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাফ, গঙ্গা নদীতে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তন ভারতীয় মনে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে সম্বন্ধে এক তীব্র সন্দেশ সৃষ্টি করে । রক্ষণশীল ভারতীয়রা এগুলির মধ্যে হিন্দু ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর তীব্র আঘাতে আভাস পান । 

● সামরিক কারণ : -   ইংরেজরা একদিন বাহুবলের সাহায্যে ভারত বর্ষ জয় করেছিল এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তি ছিল বাহুবল, কিন্তু নানা কারণে দেশীয় সিপাহিদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব তীব্র হয়ে ওঠে । 

প্রথমতঃ - দেশীয় সিপাহিদের অধিকাংশ সময়ই বহুদূর প্রদেশে যুদ্ধযাত্রা করতে হতো । এই কারণে তারা অতিরিক্ত ভাতা দাবি করে । এই দাবি না মঞ্জুর হওয়ায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় । 

দ্বিতীয়তঃ - বেতন, পদমর্যাদা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে ইংরেজ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ভারতীয় সিপাহিদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে । 

তৃতীয়তঃ - তৎকালীন ভারতীয় সমাজে সমুদ্রযাত্রা জাতিচ্যুত হওয়ারই সামিল ছিল । তাসত্ত্বেও ভারতীয় সৈন্যদের সমুদ্র অতিক্রম করে ব্রহ্মদেশে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় । 

চতুর্থতঃ - প্রথম আফগান যুদ্ধ 1839 খ্রিস্টাব্দ ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধ 1854 থেকে 1856 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সেনাবাহিনী সীমাহীন দুঃখ দুর্দশার কাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর মনে আশার সঞ্চার করে ।  তারা ইংরেজ সৈনিকদের বিরুদ্ধে প্রতি শ্রদ্ধা হারায় এবং তাদের বিরুদ্ধে জয় লাভের আশায় উৎসাহিত হয়ে ওঠে ।

পঞ্চমতঃ - এই সময় বহু সাধু-সন্ন্যাসী ও দরবেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচার করে বেড়াতেন যে পলাশীর যুদ্ধের 100 বছরের মধ্যে ভারতের ব্রিটিশ শাসন অবলুপ্ত হবে এই ভবিষ্যৎবাণী সিপাহিদের মনে প্রবল উৎসাহে সঞ্চার করে । 


● প্রত্যক্ষ কারণ : -  বিদ্রোহের ক্ষেত্র ও পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল । ঠিক এই সময় নতুন এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন বিদ্রোহে ইন্ধন যোগায় । রাইফেল এ যে টোটা ব্যবহার তো হত তার খোলসটি দাতে কেটে রাইফেলে পড়তে হতো । এই খোলসটি গরু ও শুয়োরের চর্বি দিয়ে তৈরি হতো । ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় হিন্দু-মুসলিম সিপাহীরা এই টোটা ব্যবহারে অসম্মত হয় । এই টোটা হলো মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ । 


সিপাহি বিদ্রোহের গতি 

1857 খ্রিস্টাব্দের 26 শে ফেব্রুয়ারি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর সেনানিবাসের চর্বি-মাখানো টোটা নিয়ে বিক্ষোভ দেখা দেয় । এরপর 29 শে মার ব্যারাকপুরের সেনানিবাসে মঙ্গল পান্ডে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । তার হাতে কয়েকজন ইংরেজ সামরিক কর্মচারী নিহত হন । মঙ্গল পান্ডে কে বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হিসাবে গণ্য করা হয় । তবে বহরমপুর ও ব্যারাকপুর সেনানিবাসের এইসব কাজকর্মকে প্রতিবাদ মূলক হিসাবে চিহ্নিত করা যায় -  পরিকল্পিত বিদ্রোহ এগুলি নয় । 1857 খ্রিস্টাব্দের 10 ই মে বিরাট সেনানিবাসেই প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহ শুরু হয় । বিদ্রোহ কমে দিল্লি, অযোধ্যা, লখনও, বেরিলি, ঝাসি, বিহার প্রভৃতি ভারতের এক বিরাট অঞ্চলে বিস্তৃত হয় । বিদ্রোহ দমনের জন্য সরকার কঠোর দমননীতির অবলম্বন করেন । বিদ্রোহীদের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম সত্বেও 1858 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যে সমগ্র ভারতে বিদ্রোহ দমিত হয় । 


 সিপাহি বিদ্রোহের নেতৃত্ব বৃন্দ 

সিপাহি বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র ছিল দিল্লি, কানপুর,  লখনও, বেরিলি, ঝাঁসি এবং বিহারের আরা । বিদ্রোহী সিপাইরা দিল্লির গদিচ্যুত বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে মহা বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল । তিনি নামসর্বস্ব নেতা ছিলেন মাত্র যদিও তার নামে বিদ্রোহ পরিচালিত হতো । বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে তার মত জরাগ্রস্ত, দুর্বল ও দোদুল্যচিত্ত ব্যক্তির উপস্থিতি মহাবিদ্রোহকে দুর্বল করে তোলে । দিল্লিতে বিদ্রোহ পরিচালনার মূল দায়িত্ব ছিল একদল সেনার উপর এবং তাদের নেতা ছিলেন গোলন্দাজ বাহিনীর সুবেদার বাত খান । কানপুরে বিদ্রোহের নেতা ছিলেন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এর পোষ্যপুত্র নানাসাহেব । তার পক্ষে সেনাপতি তাতিয়া টোপি ও মন্ত্রী হাকিম আজিমুল্লা বিদ্রোহ পরিচালনা করতেন । অযোধ্যার বেগম হযরত মহল তার নাবালক পুত্র বর্জিস কাদির কে সিংহাসনে স্থাপন করে নিজেই বিদ্রোহ পরিচালনা করতেন ।  ঝাঁসিতে বিদ্রোহ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব বহন করেন তরুণী বিধবা রানী লক্ষ্মীবাঈ । বিহারের মুখ্য সংগঠক ছিলেন আরার নিকটবর্তী জগদীশপুরের পদচ্যুত জমিদার অশীতিপর বৃদ্ধ কুনওয়ার সিং । ফৈজাবাদে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বৃদ্ধ মৌলবি আহম্মদুল্লা ।  আসামে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন মনিরাম দেওয়ান ।  বেরিলি নেতা ছিলেন রোহিলা নায়ক বাহাদুর খা । 


সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃতি : - 

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নেই । অনেকের মতে এটি ছিল নিছক একটি সামরিক বিদ্রোহ । অনেকে আবার 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন । আবার অনেকের মতে এটি ছিল নিছক একটি সামন্ত বিদ্রোহ । 

সিপাহী বিদ্রোহ : স্যার জন লরেন্স, স্যার জন সিলি , চার্লস রবার্টস, মুখ ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে এই বিদ্রোহ একটি সামরিক বিদ্রোহ ব্যতীত অপর কিছু ছিল না । সমকালীন বিদগ্ধ ভারতীয়দের মধ্যে প্রায় সকলেই অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কিশোরী চাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজি, সৈয়দ আহমেদ, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ সাবে আখ্যায়িত করেছেন । দেশীয় কোন রাজনৈতিক সংগঠন এই বিদ্রোহ সমর্থন করেনি ।  শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহের নিন্দা করেছেন । ভারতের ব্যাপক অঞ্চলে বিদ্রোহের কোন প্রভাব পড়েনি এবং দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ও বিদ্রোহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না এই কারণে এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ বলা হয় । 

সিপাহী বিদ্রোহ আখ্যা যুক্তিযুক্ত নয় : - কিন্তু এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করা যুক্তিসঙ্গত নয় । ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে আলোচনাকালে 1857 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে টোরি পার্টির নেতা ডিসরেলি এই বিদ্রোহকে " জাতীয় বিদ্রোহ " বলে অভিহিত করেন । সমকালীন ইংরেজ ঐতিহাসিক নর্টন, ডাফ, আউট্রাম, ম্যালেসন, জন কে, চার্লস বল, হোমস এই বিদ্রোহকে  "জাতীয় বিদ্রোহ"  হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন । বিশিষ্ট মনীষী কার্ল মার্কস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ কে ' জাতীয় বিদ্রোহ ' বলেছেন । তিনি বলেছেন যে ব্রিটিশ শাসকরা যাকে সামরিক বিদ্রোহ বলে ভাবছেন আসলে সেটা একটি জাতীয় বিদ্রোহ । তিনি অন্যত্র বলেছেন বর্তমান ভারতীয় অশান্তিটা সামরিক হাঙ্গামা নয় জাতীয় বিদ্রোহ । এই বিদ্রোহ কেবল মাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না । ভারতের বিভিন্ন স্থানের জনসাধারণ বিশেষত অযোধ্যা রোহিল খন্ড ও  বিহারের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহের যোগদান করেন । ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং, প্রমুখ রাজন্যবর্গ, বহু জমিদার ও তালুকদার এই বিদ্রোহে যোগ দেন । বিদ্রোহীরা দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে ভারতে বিদেশি প্রভাবমুক্ত এক দেশীয় শাসন ব্যবস্থায় স্থাপনে উদ্যোগী হয় । সুতারাং এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ বলা অযৌক্তিক । 

প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ : বীর সাভারকার প্রমুখ লেখকেরা এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন । বলাবাহুল্য এই মত গ্রহণযোগ্য নয় । ডাক্তার রমেশ চন্দ্র মজুমদার এর মতে 1857 খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম - প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয় । তার মতে - 

 (1) এই বিদ্রোহ ভারতের সকল অঞ্চলের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেনি । ভারতের কয়েকটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিল । 

(2) ভারতের বেশকিছু নৃপতি বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করেন । শিখ ও গোর্খা সৈনিকরা সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের পক্ষে ছিল । সমগ্র দাক্ষিণাত্য এবং বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিলেন । পাঞ্জাব, সিন্ধু দেশ ও রাজপুতনায় এই বিদ্রোহের সামান্যতম কোন শখ স্ফূরণ দেখা দেয়নি । বিদ্রোহীদের নৃশংতা ও লুটতরাজের সাধারণ জনসাধারণ তাদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে ওঠে । বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মহারাষ্ট্র অঞ্চলে বিদ্রোহের ক্ষীনপ্রকাশ দেখা যায় মাত্র । কেবলমাত্র বিহার, উত্তরপ্রদেশে ও মধ্যপ্রদেশের কোন কোন অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সাময়িকভাবে সাফল্য লাভ করলেও কেবলমাত্র অযোধ্যাতেই তা ' জাতীয় ' রূপ ধারণ করে । 

(3) বিদ্রোহ চলাকালে হিন্দু মুসলিম ঐক্য দূরে থাক, অনেক স্থানে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে এবং সম্রাট হিসেবে বাহাদুর শাহের স্বীকৃতিতে শিখ, রাজপুত ও মারাঠারা ক্ষুব্ধ হয় । 

(4) এই মহাবিদ্রোহে বিদ্রোহীদের লক্ষ্যের কোন স্থিরতা ছিল না । বাহাদুর শাহ নানাসাহেব লক্ষ্মীবাঈ সকলেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন । 

 

সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থতার কারণ 


সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পশ্চাতে নানা কারণ বিদ্যমান ছিল ।

(1) এই বিদ্রোহের কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল এবং বিদ্রোহীরা সর্বোচ্চ জনসাধারণের সমর্থন বা সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হননি । দাক্ষিণাত্য, পাঞ্জাব, রাজপুতানা, বাংলা ও সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহের কোন চিহ্ন দেখা যায়নি । 

(2) ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, বাহাদুর শাহ এবং অযোধ্যার নবাব ব্যতীত অপর কোন দেশীয় রাজা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেননি । উপরন্ত সিন্ধিয়া, নিজাম, পাঞ্জাবের শিখ ও নেপালের গোর্খা সৈন্যরা ইংরেজদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে এই বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হয় । 

(3) বিদ্রোহীদের কোন সর্বভারতীয় পরিকল্পনা ছিল না বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে এই বিদ্রোহ শুরু হয় । 

(4) বিদ্রোহীদের মধ্যে লক্ষ্যের কোন স্হিরতা ছিল না । বিভিন্ন নেতার লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ধরনের । নানা সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল ' পেশোয়া ' পদ এর পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা । লক্ষীবাঈ চাইতেন নিজ রাজ্য পুনরুদ্ধার এবং বাহাদুর শাহের লক্ষ্য ছিল মূল শক্তির পুনরুদ্ধার । 

(5) সিপাইদের মধ্যে যোগ্য নেতার অভাব ছিল । সাহেব লক্ষ্মীবাঈ, তাতিয়া টোপি প্রমুখ নেতারা সাহসী ও সমরকৌশল ছিলেন সন্দেহ নেই কিন্তু ইংরেজ সেনাপতির লরেন্স, আউটরাম , ক্যাম্বেল হ্যাভেলক প্রমুখের তুলনায় তাঁরা কিছুই ছিলেন না ।

(6) বিদ্রোহীদের আধুনিক অস্ত্র অভাব ছিল । অপরদিকে ইংরেজদের গোলাবারুদ ও আধুনিক সমরাস্ত্র কোন অভাব ছিল না । 

(7) রেলওয়ে ওর টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার ফলে ইংরেজরা যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে সক্ষম হয়, ভারতীয় সিপাহিদের তা ছিল না । 

(8) ইংরেজদের কূটকৌশলেও এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহের সময় ভারতীয়দের ভীতি প্রদর্শন করে এবং প্রয়োজনে চাকরি ও পুরস্কার এর লোভ দেখিয়ে বিদ্রোহে যোগদান থেকে বিরত করা হয় । এইভাবে শিখদের বিদ্রোহ দমনের কাজে নিয়োগ করা হয় । 


সিপাহী বিদ্রোহ 1857 থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর 


(1) সিপাহী বিদ্রোহ প্রথম কোথায় এবং কবে শুরু হয় ? 

ANS:  ব্যারাকপুরে শুরু হয় 1857 খ্রিস্টাব্দের 29 মার্চ 

(2) মঙ্গল পান্ডে কে ছিলেন ?

ANS:  সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ 

(3) নানাসাহেব কে ছিলেন ? 

ANS:  পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এর দত্তকপুত্র এবং সিপাহী বিদ্রোহের অগ্রগণ্য নেতা । 

(4) ভারত শাসন আইন কবে প্রবর্তিত হয় ?

ANS:  1858 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে 

(5) সিপাহী বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য হল কি ?

ANS:  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান 

(6) ভারতের প্রথম ভাইসরয় কে ছিলেন ? 

ANS:  লর্ড ক্যানিং 

(7) সিপাহী বিদ্রোহের পর গভর্নর জেনারেলের কি পদবী দেওয়া হয় ? 

ANS:  ভাইসরয় 

(8) ভারতের শেষ মুঘল সম্রাট কে ছিলেন ?

ANS:  দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ 

(9) ঝাঁসির রানী বিখ্যাত কেন ?

ANS:  ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন 

(10) সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন ?

ANS:  লর্ড ক্যানিং 

(11) সিপাহী বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম লেখ ? 

ANS:  তাতিয়া টোপি ও কুনওয়ার সিং 

(12) দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে কোথায় নির্বাসিত করা হয়েছিল ? 

ANS:  ব্রহ্মদেশের বর্তমান মায়ানমারের রেঙ্গুনে 

(13) কানপুরে সিপাহী বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন ?

ANS:  নানাসাহেব 

(14) আজিমুল্লাহ খাঁ কে ছিলেন ?

ANS:  নানা সাহেবের প্রচার সচিব ও 1857 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ।