নিউটনের গতিসূত্র

Newton's laws of motion

1687 সালে মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন তার ' প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা ' গ্রন্থে জড় বস্তু ও গ্রহ-নক্ষত্রের গতির ভিত্তিতে তিনটি সূত্র উল্লেখ করেন এই সূত্রগুলি গতিবিদ্যা ও প্রযুক্তি বিদ্যার স্তম্ভ স্বরূপ । এই সূত্র তিনটি নিউটনের গতিসূত্র নামে খ্যাত । সূত্র গুলি হল —  


নিউটনের তিনটি গতিসূত্র 

প্রথম সূত্র :  বাইরে থেকে প্রযুক্ত বল দ্বারা অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য না করলে, স্থির বস্তু চিরকাল স্থির অবস্থায় থাকবে এবং সচল বস্তু চিরকাল সমবেগে একই সরলরেখায় চলতে থাকবে । 


দ্বিতীয় সূত্র :  কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে প্রযুক্ত হয়, ভরবেগের পরিবর্তন ও সেদিকে ঘটে । 


তৃতীয় সূত্র :  প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে । 


1. নিউটনের প্রথম সূত্রের আলোচনা (Discussion of the first law)

নিউটনের প্রথম গতিসূত্র থেকে আমরা যে দুটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা পায় তা হল (a) পদার্থের জাট এবং (b) বলের সংজ্ঞা । 

  🌑 (a) পদার্থের জাড্য (Inertia of matter) :  নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে জানা যায় যে, স্থির বস্তুর নিজে থেকে সচল হতে পারে না । কিংবা সচল বস্তুর নিজের থেকে তার গতিশীল অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে না । স্থির বস্তুর ধর্ম চিরকাল স্থির থাকা এবং গতিশীল বস্তুর ধর্ম সমবেগে একই সরলরেখায় চলতে থাকা । এটি জড় পদার্থের একটি মৌলের ধর্ম । এই ধর্মে জন্যই বস্তু তার স্থিতি বা গতির অবস্থা পরিবর্তনের যেকোনো চেষ্টাকে বাধা দেয় । পদার্থের এই ধর্মের নাম জাড্য বা জড়তা (intertia) । এইজন্য নিউটনের প্রথম সূত্র কে জাড্যর সূত্র বা জড়তা সূত্র বলে । 


  🌑 জাড্য : যে ধর্মের জন্য কোনো জড় বস্তু তার স্থিতি বা গতির অবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করে, সে ধর্মকে পদার্থের জাড্য বলে । বস্তুর ভর যত বেশি হয়, তার জাড্যও তত বেশি হয় । সুতরাং বলা যায় - বস্তুর ভরই তার জাড্যের পরিমাপ

জাড্য দুই প্রকার — (1) স্থিতি জাড্য এবং (2) গতি জাড্য  


  🌑 স্থিতি জাড্য (Inertia of rest) :  যে ধর্মের জন্য স্থির বস্তুর চিরকাল স্থির অবস্থায় থাকতে চায়, তাকে স্থিতি জাড্য বলে । 


উদাহরণ : (i) কোনো বাস স্থির অবস্থা থেকে হঠাৎ চলতে শুরু করলে বাসের মধ্যে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা পিছনের দিকে হেলে পড়ে । কারণ বাসটি যখন স্থির থাকে যাত্রীর দেহ তখন স্থির থাকে । এবার বাসটি হঠাৎ চলতে শুরু করলে যাত্রীর পা দুটো গাড়ির সংলগ্ন থাকায় গাড়ির সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে যায় । কিন্তু তাঁর দেহের উপরের অংশ স্থিতি জাড্যের জন্য স্থিতি অবস্থা বজায় রাখতে চায় । ফলে যাত্রীরা পেছনের দিকে হেলে পড়ে । 

(ii) পরীক্ষাগারে স্থিতি জাড্য বোঝাতে নিচের পরীক্ষাটি করা হয় ।  



পরীক্ষা : একটি খাড়াদণ্ডের মাথায় যুক্ত একটি ছোট বাটির উপর একটি কার্ডবোর্ড রাখা হলো । এই কার্ডবোর্ডের উপর একটি ধাতব বল এমন ভাবে রাখা হল যেন বাটিটি বলটির  ঠিক নিচে থাকে । বাটি সহ দন্ডটির পাশে অপর একটি খাড়াদণ্ডের মাথার যুক্ত একটি হুকের সঙ্গে একটি স্প্রিং আটকানো আছে । এবার ঐ স্প্রিং এর সাহায্যে কার্ডবোর্ডটিকে থেকে সজোরে আঘাত করলে কার্ডবোর্ডটি  ছিটকে বেরিয়ে যায় । কিন্তু স্থিতি জাড্যের জন্য ধাতব বলটি তার আগের অবস্থা বজায় রাখে এবং বলটির নিচে কার্ডবোর্ড না থাকায় বলটি বাটির মধ্যে পড়ে । 


  🌑 গতি জাড্য ( Inertia of motion ) : যে ধর্মের জন্য সচল বস্তু চিরকাল সমবেগে একই সরলরেখায় চলতে চায়, তাকে গতি জাড্যে বলে ।  

উদাহরণ : (i) চলন্ত বাস হঠাৎ থেমে গেলে বাসের ভেতরের যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কারণ, বাসটি যখন গতিশীল অবস্থায় থাকে, তখন বাসের যাত্রীর দেহের সমস্ত অংশই বাসের সঙ্গে সমবেগে থাকে । এবার বাসটি হঠাৎ থেমে গেলে যাত্রীর পা দুটো গাড়ির সংলগ্ন বলে হঠাৎ স্থির হয়ে যায়, কিন্তু দেহের উপরের অংশ গতিজাড্যের দরুন সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে যায় । ফলে যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে । 

(ii) সমবেগে চলন্ত ট্রেনের ভেতরে  বসে কোনো যাত্রী একটি বলকে সোজা উপরের দিকে ছুড়ে দিলে বলটি আবার তার হাতে এসে পড়ে । গতি জাড্যর ফলেই এমন হয় । কারণ, চলন্ত ট্রেনের মধ্যে যাত্রী ও বল উভয়ই ট্রেনের বেগে চলে । তাই উপরের দিকে ছুড়ে দিলেও গতি জাড্যের জন্য বলটি টেনের বেগেই সামনের দিকে এগিয়ে চলে এবং একইসঙ্গে নিচে নামতে থাকে । ফলে বলটি আবার চলন্ত ট্রেনের যাত্রী হাতে নেমে আসে । গতিজাড্য না থাকলে ছুঁড়ে দেওয়ার পর বলটিকে পিছনের দিকে চলতে দেখা যেত । 


  🌑 (b) বলের সংজ্ঞা (Defination of force) : নিউটনের প্রথম সূত্র দেওয়া বলের সংজ্ঞা অনুসারে বল হল এমন একটি রাশি যা পদার্থের জড় অবস্থার পরিবর্তন অর্থাৎ স্থির পদার্থকে সচল ও সচল পদার্থের বেগ পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাইরের থেকে বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করা সত্বেও বস্তুর জড় অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না । যেমন, হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে একটি বড় গাছকে সরানো যায় না । আবার উপর থেকে নিচের দিকে গড়ানো একটি খুব ভারী পাথর কে হাত দিয়ে থামানো যায় না । এখানে প্রযুক্ত বল যদিও বস্তুর অচল বা সচল অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করে, কিন্তু সক্ষম হয় না । অতএব, 

   🌑  বলের সংজ্ঞা :  বাইরে থেকে যা প্রয়োগ করে কোন বস্তুর স্থির বা গতিশীল অবস্থার পরিবর্তন করা হয় বা পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয় তাকেই বল (Force) বলে ।


2.  নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের আলোচনা (Discussion of the Second law) :

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে বলের পরিমাপ করা যায় । এজন্য ভরবেগ সম্পর্কে জানা দরকার ।

   🌑  ভরবেগ (Momentum) : ভর ও বেগ এর সমন্বয়ে কোন গতিশীল বস্তু তে যে পরিমাণ গতি সৃষ্টি হয়, তাকে বস্তুটির ভরবেগ বলে । বস্তুর ভরবেগ বস্তুর ভর ও বেগের গুনফল সমান ।

মনে করি, কোন বস্তুর ভর M এবং বেগ V, তাহলে বস্তুটির ভরবেগ  = বস্তুর ভর x বস্তুর বেগ = mv । ভর একটি স্কেলার রাশি কিন্তু বেগ একটি ভেক্টর রাশি । তাই এদের গুনফল ভরবেগ একটি ভেক্টর রাশি । ভর বেগের মান এবং অভিমুখ 2 আছে । বেগের অভিমুখী হলো ভরবেগের অভিমুখ । 

  🌑  ভরবেগের একক : এস.আই. পদ্ধতিতে ভরবেগের একক কিলোগ্রাম মিটার / সেকেন্ড এবং সি .জি .এস পদ্ধতিতে ভরবেগের একক গ্রাম সেন্টি মিটার / সেকেন্ড । 


3.  নিউটনের তৃতীয় সূত্র আলোচনা  ( Discussion of the Third law ) : 

নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলা হয়েছে যে প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে । 

   🌑  ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া : এই সূত্রে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বলতে দুটি ভিন্ন বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল কে বোঝানো হয়েছে । এই সূত্র অনুযায়ী যখনই কোনো বস্তু অন্য কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে তখনই দ্বিতীয় বস্তুটিও প্রথম বস্তুটির উপর একটি সমান ও বিপরীতমুখী বলপ্রয়োগ করে ।এক্ষেত্রে প্রথম বস্তু দ্বিতীয় বস্তু উপরে যে বলপ্রয়োগ করে, যদি তাকে ক্রিয়া (Action) বলা হয়, তবে দ্বিতীয় বস্তু প্রথম বস্তুর উপর যে বলপ্রয়োগ করে সেই বলকে প্রতিক্রিয়া (reaction) বলে । এই দুটি বল সব সময় একই সঙ্গে ক্রিয়া করে । ক্রিয়া যতক্ষণ স্থায়ী হয়, প্রতিক্রিয়াও ঠিক ততক্ষন স্থায়ী হয় । প্রতিক্রিয়ার মান ক্রিয়ার উপরই নির্ভরশীল ক্রিয়া না থাকলে প্রতিক্রিয়া থাকে না । ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া একই সময়ে ভিন্ন বস্তুর উপর প্রযুক্ত হয় ; অর্থাৎ বল দুটির প্রয়োগ বিন্দু আলাদা । এজন্য ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া পরস্পর সমান ও বিপরীত হলেও এরা কখনও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না । কারণ সমান ও বিপরীতমুখী দুটি বল একই বস্তুর উপর ক্রিয়া করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে । 

বস্তু দুটি স্থির থাকুক বা সচল থাকুক, একে অপরের সংস্পর্শ থাকুক বা পরস্পর থেকে দূরে থাকুক  সবক্ষেত্রেই তৃতীয় সূত্রটি প্রযোজ্য হবে 

   🌑 তৃতীয় সূত্রের উদাহরণ : 



(i) কোন আরোহী নৌকা থেকে লাভ দিয়ে তীরে নামলে নৌকাটি পিছনের দিকে সরে যায় । নৌকো থেকে তীরে লাভ দেওয়ার সময় আরোহী নৌকার উপর দিয়ে বল প্রয়োগ করে তা হল ক্রিয়া । এর ফলে নৌকাটি পিছনের দিকে সরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটি ও আরোহী উপর সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে যার ফলে আরোহী সামনের দিকে গতিশীল হয়ে তীরে পৌঁছায় । 

(ii) ক্রিকেট খেলায় বোলার বল করলে ব্যাটসম্যান যখন ব্যাট দিয়ে বলটিকে আঘাত করে তখন বলের উপর ব্যাটের ক্রিয়ায় বলটি সামনের দিকে এগিয়ে যায় । সঙ্গে সঙ্গে বলটিও ব্যাটের উপর একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে । যার ফলে ব্যাটটি কিছুটা পেছনের দিকে সরে যায় । 

(iii) বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ার সময় নলের মধ্যে গুলির উপর বল প্রযুক্ত হয় । তার ক্রিয়ায় গুলিটি প্রচন্ড বেগে সামনের দিকে ছুটে যায় । সঙ্গে সঙ্গে গুলিটিও বন্দুকের উপর সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে ।যার ফলে বন্দুকটি পেছন দিকে ধাক্কা দেয় । 

(iv) হাউই বাজিতে আগুন দিলে এর ভেতরের বারুদের দহনের ফলে উৎপন্ন গ্যাস নিচের ছিদ্র দিয়ে তীব্রবেগে বেরোতে থাকে । এটি হলো ক্রিয়া । সঙ্গে সঙ্গে হাউইটিতে একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বলের সৃষ্টি হয় । এর জন্য হাউই টি তীব্রবেগে উপরের দিকে উঠে যায় । 

   🌑 জেট বিমান ও রকেট : জেট বিমান ও মহাকাশ যানের রকেটের কার্যনীতি নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত ।



  ◼ জেট বিমানের  :  জেট বিমানের  ইঞ্জিন এর মধ্যে জ্বালানি থাকে । যখন বিমানটি চলতে শুরু করে তখন বিমানের সামনের ছিদ্র দিয়ে বায়ু সবেগে জ্বালানির সঙ্গে মিশে উচ্চচাপে দহন কার্য চালায়, ফলে আবদ্ধ আধারে গ্যাস উৎপন্ন হয় । ঐ গ্যাস অতিরিক্ত বায়ুর সঙ্গে মিশে বিমানের পেছনের দিকে একটি সরু নল এর মধ্যে দিয়ে প্রচন্ড বেগে বের হতে থাকে । এই গ্যাস প্রভাবকে জেট (jet) বলে । এর ফলে উৎপন্ন প্রতিক্রিয়া বল বিমানটিকে সামনের দিকে গতিশীল করে ।তখন বিমানটি তীব্র গতিতে আকাশপথে এগিয়ে চলে । জেট বিমানে পেট্রোল ও বায়ুর মিশ্রণকে  জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় । তাই খুব বেশি উঁচুতে যেখানে বায়ুর ঘনত্ব খুব কম সেখানে যেয়ে 3 দিন কাজ করতে পারে না । 



◼ রকেট :  রকেটের কার্যনীতি অনেকটা জেট বিমানের মত । রকেটের দহন কক্ষে পাম্পের সাহায্যে তরল গ্যাসোলিন ও তরল অক্সিজেনের মিশ্রণকে প্রবেশ করানো হয় । এবং যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ওই জ্বালানি কে জালানো হয় । মিশ্রণটি জ্বললেই অতিউচ্চ চাপে গ্যাস উৎপন্ন হয়ে রকেটের নিচের দিকের একটি সরু নল এর মধ্যে দিয়ে বের হতে থাকে । এর ফলে বিপরীতমুখী যে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া বলের সৃষ্টি হয়, সেই প্রতিক্রিয়া বলই রকেটকে তীব্রবেগে মহাকাশে পৌঁছে দেয় । 


◼ জেট বিমান কে আবহাওয়া মন্ডল থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করতে হয় । যে কারণে জেট বিমান বায়ুমন্ডলে উপরে উঠতে পারেনা । কিন্তু রকেটের খোলে জ্বালানি ও তরল অক্সিজেন থাকে । তাই রকেট উৎক্ষেপণের জন্য বায়ুর প্রয়োজন হয় না । এছাড়া বায়ুশূন্য ঊর্ধ্বাকাশে বায়ুর ঘর্ষণজনিত বাধা না থাকায় রকের তীব্র বেগে উপরে উঠে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করতে পারে ।